একজন মানবপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবকের গল্প।
২১ অক্টোবর, ২০২৪, 12:26 AM
NL24 News
২১ অক্টোবর, ২০২৪, 12:26 AM
একজন মানবপ্রেমী স্বেচ্ছাসেবকের গল্প।
প্রতিবেদক জসিম উদ্দিনঃ
হাকালুকি হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশির গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবুজে ঘেরা জুড়ী উপজেলার পূর্ব বেলাগাঁও নামক ছোট্ট গ্রামে তার জন্ম। হাওরে কলকলিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছজলের স্পন্দনের সঙ্গে ছুটে চলা তার শৈশব ও কৈশোরের ইতিকথা। হাওরের অকৃত্রিম সৌন্দর্য তাকে খুব কাছে থেকে আকৃষ্ট করেছে। গড়ে তুলেছে প্রকৃতি ও মানবপ্রেমী হিসেবে। হাওর পাড়ের সন্তান হওয়ায় খুব কাছে থেকে উপলব্ধি করেছে জলের উত্থানপতন। প্রত্যক্ষ করেছেন হাওর পাড়ের মানুষের জীবন সংগ্রাম। কখনো সুবিশাল জলতীরের মানুষদের দুঃখে ভাসায়। আবার একবুক উজ্জ্বল স্বপ্ন দিয়ে আনন্দে ভাসায়। জলের সঙ্গে মানবজীবনের এই উত্থানপতন তাকে ভাবিয়েছে। চিন্তার কোষগুলো একসময় মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তারপর থেকেই শুরু স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের।
যেকোনো সংকট ও সচেতনতামূলক কাজে তার রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। চাকরির সুবাদে যে জেলাতেই পাড়ি জমাক-না কেন, সেখানে তার প্রথম কাজ হয় কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যুক্ত হওয়া। ২০০৯ সালে রাজধানীর শান্তিভাগ এলাকায় অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা ‘শিশু ছায়া’ নামক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রিয়জনকে বাঁচাতে এক ব্যাগ রক্তের জন্য যখন সবাই দিশাহারা, তখন পরিচিত বন্ধুদের ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেন তিনি। মানবপ্রেমী এই স্বেচ্ছাসেবকের নাম মোঃ হাবিবুর রহমান মুরাদ। জন্ম মৌলভীবাজার জেলা, জুড়ী উপজেলার হাওরঘেঁষা চিরসবুজ গ্রামে হলেও চাকরির টানে শিকর গেড়েছে রাজধানির শান্তিভাগ এলাকায়।
সেখানে একটি ফাস্টফুডের দোকানেই তার কর্ম জীবন শুরুর সুবাদে এই ঢাকায় প্রথম পদার্পণ তার। চাকরির জন্য হাওরের ছেলে শহরে পাড়ি জমালেও হাওর পাড়ের সেই মানবিক শিক্ষা তাকে চাকরির চেয়ার আটকে রাখতে পারেনি।
মানবতার টানে ছুটে চলেছে রাস্তায়, কুঁড়েঘরে অথবা অসচেতন কোনো পল্লীতে। মানবিক চিন্তা থেকেই তার মানবসেবার শুরু। সমাজের আর দুটো মানবশিশুর মতো পথশিশুরা যখন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। অবহেলিত হাজারো দুস্থ-দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের মৌলিক চাহিদা থেকে। অসচেতনতায় যখন জীর্ণ-সংকীর্ণ পৃথিবীর চারপাশ। আমাদের অমানবিকতায় যখন আগামীর প্রজন্ম সুন্দর পৃথিবী হতে অবহেলিত, ঠিক তখন নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকা হাবিবুর রহমান মুরাদের মানব দর্শনের বিপরীত। তাই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই সামাজিক স্বেচ্ছাসেবার যাত্রা। এই পথকে আরো সুগম করতে যোগ দেয় জাগো ফাউন্ডেশনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ভিবিডিতে। ভিবিডি মূলত এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে। তাদের এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো তার মানবসেবার চিন্তার পরিপূরক। তাই লোককথা-সমালোচনা উপেক্ষা করে রাজধানী শাখার ভিবিডির সঙ্গে কাজ শুরু করে ২০১০ থেকে।
বর্তমানে যুক্ত আছে ‘নাগরিক শিক্ষা’ নামক প্রজেক্টের জেলা ট্রেইনার হিসেবে। শহরে অবহেলিত শিশুদের শিক্ষার জন্য বিনা খরচে পাঠদান কর্মসূচি, আধুনিক সময়োপযোগী শিক্ষা সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন কর্মসূচি। পরিবেশ বিপর্যয় থেকে পৃথিবীকে মুক্তিদানের লক্ষ্য সচেতনতা সৃষ্টি, শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ময়লা পরিষ্কার কর্মসূচিসহ নানা রকম স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত নিজের খেয়ে বনের মহিষ চড়ানোর মতো সমালোচনা উপেক্ষা করে কাজ করে চলেছে।
এরইমধ্যে ঘরে তুলেছেন "সেইভ লাইফ ব্লাড ডোনেট সোসাইটি" নামক আরো একটি সংগঠন।
মানুষ যখন খুব বিপদে পড়ে তখন অন্য কারো শরণাপন্ন হয়। বিশেষ করে যখন রক্তের প্রয়োজন হয় তখন মানুষ দিশাহারা হয়ে ওঠে। কোথায় পাবে, কীভাবে পাবে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করলে রক্ত পাওয়া যাবে? সেই চিন্তা যেন তখন আকাশ সমান হয়ে দাঁড়ায়।
সেই ভাবনা থেকেই ২০২২ সালের ১০ জানুয়ারি গুটিকয়েক বন্ধু নিয়ে শুরু করে সেইভ লাইফ নামক সংগঠন।
আজকের দিন পর্যন্ত এই সংগঠনের সারাদেশে প্রায় ৪০ টি জেলা শাখা রয়েছে। এই ৪০টি জেলার সকল দায়িত্বশীলদের সহযোগিতায় সম্পুর্ন বিনামূল্যে ১৮৯০০ ব্যাগেরও বেশি রক্ত তারা মানুষকে দিয়েছে। বিনামূল্যে করিয়েছেন ৩ হাজারেরও অধিক মানুষের রক্তের গ্রুপ পরিক্ষা। তার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও ভালোবাসার কাজ ছিল করোনার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে। করোনার তান্ডবে যখন সারা পৃথিবী অসহায়। চারদিকে স্বজন হারোনার হাহাকার, ঠিক তখন অসচেতন নগরবাসীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি, মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে পরামর্শ প্রদান, এমনকি অক্সিজেন সিলিন্ডার সংকটে যখন চোখের সামনে আপনজন ছটফট করে মারা যাচ্ছিল, কিন্ত প্রিয় মানুষগুলো নিরুপায় কিছু করার ছিল না। এমন অবস্থায় নিশ্চুপ ঘরে বসে থাকতে পারেনি সে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলেছে সবার দুয়ারে দুয়ারে।
করোনা ভীতিহীন শহর নিশ্চিত করতে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও জীবাণুনাশক স্প্রে ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কাজ করে। করোনার পর স্বাভাবিক পৃথিবীতেও থেমে নেই তার কার্যক্রম, প্রতিনিয়ত কাজ চলছে অসচেতন মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রতিষ্ঠা ও সেইভ লাইফ এর লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের মূলমন্ত্র একটাই, অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। জীবন বাজি রেখে মানুষের সেবার মাঝেই তার সুখ। তার মতে, দুঃখী মানুষের ফ্যাকাসে গালে কোমল গোলাপ পাপড়ির ন্যায় ফোকলা দাঁতের অকৃত্রিম ও আত্মতুষ্টির হাসি আমার এ কাজের অনুপ্রেরণা। মানুষের ভালোবাসা নিয়ে এ কাজে আরো সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন বুনি। সামাজিকভাবে সামান্য সুনজর সামাজিক ও মানবিক কাজে আমাকে আরো অনুপ্রেরণা জোগাবে।